মানুষ মৃত অবস্থা থেকে জেগে ওঠে কেন !

“কুল্লু নাফসিন যা-ইকাতুল মাওত” “কুল্লু নাফসিন যা-ইকাতুল মাওত” – নিশ্চয়ই প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে। [সুরা আলে ইমরান] । জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে, চিরস্থির কবে নীর, হায় রে, জীবন-নদে ? [ মাইকেল মধুসূদন দত্ত ] । মৃত্যু কি সহজ, কি নিঃশব্দে আসে অথচ মানুষ চিরকালই জীবন নিয়ে গর্ব করে যায় । — সমরেশ মজুমদার ।মৃত্যুর মতো সত্য নেই । কিন্তু আপনি কি জানেন কিছু মানুষকে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করার পরেও তারা মৃত অবস্থা থেকে জেগে ওঠেছে । এ নিয়েই অন্বেষা.নেট - এর আজকের আয়োজন মানুষ মৃত অবস্থা থেকে জেগে ওঠে কেন !

মৃত্যু কি
মৃত্যু কি ?

মৃত্যু কি ?

মৃত্যু বলতে জীবনের সমাপ্তি বুঝায়। জীববিজ্ঞানের ভাষায় প্রাণ আছে এমন কোন জৈব পদার্থের (বা জীবের) জীবনের সমাপ্তিকে মৃত্যু বলে। তবে অবাক করা তথ্য হলেও সত্য যে বিজ্ঞানে এখনো মৃত্যু সমন্ধে কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই । একটি জীবের কখন চূড়ান্ত বা সামগ্রিক মৃত্যু ঘটে, তার উত্তর আজও বিজ্ঞানের কাছে অজানা ।

২০১৭ সালে নিউইয়র্ক শহরের এনওয়াইইউ ল্যাংগোন স্কুল অব মেডিসিনের ক্রিটিক্যাল কেয়ার অ্যান্ড রেসাসিটেশন রিসার্চ বিভাগের প্রধান স্যাম পারনিয়া এক গবেষণায় দাবি করেন, তাত্ত্বিকভাবে কোনো ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করা হলেও একেবারে ফুরিয়ে যান না তিনি। তাঁর চেতনা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সজাগ থাকে এবং তিনি অন্যের কথা শুনতে পান। কিন্তু তাঁর কিছু করার মতো শক্তি বা সামর্থ্য থাকে না।

আরো পড়তে পারেন

সত্যিই কি এলিয়েন আছে ?

পৃথিবী থেমে গেলে কি হবে ?

১৮৪৬ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে মৃত্যুর সংজ্ঞা নির্ধারনে একাডেমি অব সায়েন্স একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে । ওই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া তরুণ এক চিকিৎসক মৃত্যুর একটি সংজ্ঞা প্রদান করেন যাতে বলা হয়, স্টেথিসকোপের মাধ্যমে চিকিৎসকেরা যদি দুই মিনিট কোনো হৃৎস্পন্দন না পান, তবে নিশ্চিতভাবেই সে মৃত । মৃত্যুর এই সংজ্ঞা প্রদান করে তিনি প্রতিযোগিতায় জয় লাভ করেন ।

কিন্তু ১৯২০-এর দশকের এক আবিষ্কারে দেখা যায়, হৃৎস্পন্দন বন্ধের পরও রোগীর বেঁচে ওঠার সুযোগ রয়েছে । ১৯২০ সালে তড়িৎ প্রকৌশলী কৌয়েনহোভেন ডিফিব্রিলেটর আবিষ্কার করেন । যার মাধ্যমে হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়া রোগীকে সঠিক মাত্রার ভোল্টেজ প্রয়োগ করে ঝাঁকুনি দিয়ে পুনরায় হৃৎস্পন্দন চালু করা যায় ।

অন্যদিকে যখন আমাদের মস্তিষ্ক ব্যাথা সৃষ্টিকারী কোনো উদ্দীপনা, আলো, বা শব্দের প্রেক্ষিতে কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে পারেন না তখন ওই অবস্থাকে কোমা বলে। তাই হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়া বা মস্তিষ্ক তার ক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়া কোনটিই একেবারে মৃত্যু নয় । মৃত্যুকালে মানুষ ধারাবাহিকভাবে ছোট ছোট মৃত্যুর ভেতর দিয়ে যায়। আলাদা আলাদা টিস্যু আলাদা আলাদা সময়ে মারা যায়।

পাশাপাশি জীবন-মৃত্যুর ধারাবাহিকতায় কোনো ব্যক্তি মারা যাওয়ার পরও কয়েক দিন পর্যন্ত ত্বক এবং মস্তিষ্কের স্টেম সেল বেঁচে থাকে। পেশির স্টেম সেল মৃত্যুর আড়াই সপ্তাহ পরও জীবিত পাওয়া গেছে। এমনকি শেষনিশ্বাস নেওয়ার পর দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আমাদের জিন বেঁচে থাকে। মৃত্যুর কোনো ধরনের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা না থাকাই মূলত মানুষ মৃত অবস্থা থেকে জেগে ওঠার অন্যতম কারণ ।

আরো পড়তে পারেন

মানুষ মৃত অবস্থা থেকে জেগে ওঠে কেন ?

মৃত' ঘোষণা করার পর জেগে ওঠার বা জীবিত হওয়ার ঘটনাকে বলা হয় ল্যাজারাস সিনড্রোম। এই নামটি নেয়া হয়েছে বাইবেলে বর্ণিত ল্যাজারাস নামে এক ব্যক্তির কাহিনি থেকে। বলা হয় যে, ল্যাজারাসকে তার মৃত্যুর চার দিন পর জীবিত করেছিলেন যিশু খ্রিস্ট।

ল্যাজারাস সিনড্রোম কেন ঘটে চিকিৎসা বিজ্ঞানে তার সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য নেই । তবে এ পর্যন্ত দুটি তত্ত্বকেই এই ল্যাজারাস সিনড্রোমের জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে সিপিআর দেয়া। সিপিআর হচ্ছে কৃত্রিম শ্বাস দেওয়ার প্রক্রিয়া । সিপিআর এর পুরো অর্থ (Cardio Pulmonary Resuscitation) কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন। এটি First-aid এর একটি অঙ্গ। যখন সিপিআর দেয়া হয় তখন ফুসফুসে অনেক বাতাস জমে। সেটি বের হতে পারে না। কিন্তু সিপিআর দেয়া শেষ হয়ে গেলে বাতাস বের হতে থাকে এবং রক্ত সঞ্চালন শুরু হয়। যার কারণে মানুষ মৃত অবস্থা থেকে জেগে ওঠেতে পারে ।


মানুষ মৃত অবস্থা থেকে জেগে ওঠে কেন !
এ পর্যন্ত দুটি তত্ত্বকেই এই ল্যাজারাস সিনড্রোমের জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়।

আর দ্বিতীয়ত হলো মানুষকে জরুরী ভিত্তিতে যে ইনজেকশন দেয়া হয়, সেটি হয়তো তাৎক্ষণিক ভাবে কাজ করে না। কিন্তু কিছুক্ষণ পর হয়তো সেটি কাজ করা শুরু করে এবং হৃদযন্ত্র চালু হয়ে যায়। এতে করে ওই ব্যক্তির মধ্যে অনুভূতি ফিরে আসে। যার করণেও মানুষ মৃত অবস্থা থেকে জেগে উঠতে পারে ।

সাধারণত হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা রোগীদের ক্ষেত্রে ল্যাজারাস সিনড্রোম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে । বেশির ভাগ সময়েই হাসপাতালে যারা জেগে ওঠেন তারা কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার মারা যান। তবে অনেকেরই জেগে ওঠার পর বছরের পর বছর সুস্থ অবস্থায় বেঁচে থাকার কথা শোনা গেছে ।

মানুষ মৃত অবস্থা থেকে জেগে ওঠার কয়েকটি ঘটনা

আপনাদের নিশ্চই ২০২০ সালের ১৬ অক্টোবরের ঘটনা মনে আছে । ওই দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শাহিনুর বেগম নামে এক নারী এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন । জন্মের পরপরেই নবজাতকটিকে মৃত ঘোষনা করেন দায়িত্বরত চিকিৎসক । কিন্তু শিশুটির বাবা ইয়াসিন মোল্লা সন্তানকে দাফন করার আগে শিশুটি নড়ে ওঠে । এই নিয়ে তখনকার সংবাদ মাধ্যম গুলো সরগরম ছিল । প্রথম আলোরতে বলা হয়ছে দাফনের ঠিক আগমুহূর্তে কেঁদে উঠল শিশুটি ।

শুধু বাংলাদেশেই বিভিন্ন সময় এরকম আরো কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় । ২০১৬ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর ফরিদপুর জেলার আলীপুরে জন্মের কিছুক্ষণ পর একটি শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করেন স্থানীয় একটি হাসপাতালের চিকিৎসক। পরে কবর দেয়ার আগে হঠাৎ করেই কেঁদে ওঠে শিশুটি। কবর দেওয়ার আগে কেঁদে উঠল 'মৃত' নবজাতক

ল্যাজারাস সিনড্রোমের আরেকটি ঘটনা ঘটে ২০১৩ সালে ইংল্যান্ডের উইল্টশায়ারে। সেখানে ক্যারল ব্রাদার্স নামে ৬৩ বছর বয়সী এক নারীর হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার ৪৫ মিনিট পর আবার জেগে ওঠেন তিনি।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রথম ১৯৮২ সালে এ ধরণের ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। এর পর ১৯৯৩ সালে এই ঘটনাগুলোকে ল্যাজারাস সিনড্রোম হিসেবে উল্লেখ করা হয়। জার্নাল অব দ্য রয়াল সোসাইটি অব মেডিসিন এর একটি গবেষণা প্রতিবেদনে ল্যাজারাস ফেনোমেনা বিষয়ে বলা হয়, এখনো পর্যন্ত ৩৮টি ল্যাজারাস সিনড্রোমের ঘটনাকে নথিবদ্ধ করা হয়েছে ।

আরো পড়তে পারেন

তবে এই প্রতিষ্ঠানটির মতে, এধরণের অনেক ঘটনা রয়েছে যেগুলো কখনো নথিবদ্ধ হয়নি এরকমের অনেক ঘটনা সংবাদ মাধ্যমের খবরে প্রায়ই দেখা যায় বলেও এতে উল্লেখ করা হয়।যে ৩৮টি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে মেডিকেল জার্নালগুলোতে - তাদের মধ্যে সাত জন বাদে বাকিদের গড়ে ২৭ মিনিট ধরে সিপিআর দেয়া হয়েছিল।

এই ৩৮ জনের মধ্যে ১৭ জন জেগে উঠার পরপরই আবার মারা যায়। বাকি ১৭ জনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। এদের মধ্যে তিন জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। আর ১৪ জন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যায়। বাকি ৪ জন রোগীর ক্ষেত্রে তেমন কোন তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

তথ্য সূত্র : বিবিসি , উইকিপিডিয়া , প্রথম আলো এবং আন্যান্য 

আশা করি ভালো লেগেছে । ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে তাদের কেও জানার সুযোগ করে দেওয়ার অনুরোধ রইলো । এ ধরনের পোস্ট পেতে অন্বেষা.নেট এর সাথে থাকুন।

আরো পড়তে পারেন

জুয়েল

আমি বিশ্বাস করি শিক্ষা কোনো বাণিজ্যিক পণ্য নয়। শিক্ষা সকলের অধিকার। আসুন আমরা প্রত্যেক শিশুর স্বপ্ন জয়ের সারথি হই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন