একটি হুইলচেয়ারের গল্প : স্টিফেন হকিং

হুইল চেয়ার, সামনে বসানো কম্পিউটার, মাথাটি কাত হয়ে পড়ে আছে, এঁকে বেঁকে বসা নিথর শরীরটি যেন নিরেট মূর্তি। হাত আছে কিন্তু কাজ করে না, পা আছে চলে না, মেরুদন্ড আছে দাঁড়ায় না, মুখ আছে খায় না, জিহবা আছে কথা বলে না। সারা শরীরে জীবিত বলতে আছে দু’টি চোখ। উজ্জ্বল নীল ঐ দু’টি চোখের তীব্র চাহনি পৃথিবীর বলয় পেরিয়ে মহাবিশ্বের মহাকাশে তারায় তারায় ঘুরে বেড়ায়। আহরণ করে জ্ঞান। 

একটি হুইলচেয়ারের গল্প
স্টিফেন হকিং

কোন রকম প্রতিবন্ধকতা তাকে থামাতে পারেনি। যিনি বর্তমান সহ ভবিষ্যতের যে কোন মানুষের জন্য হতে পারেন অনুপ্রেরণা । হ্যাঁ, নিশ্চই ধারণা করতে পারছেন কার কথা বলছি । তিনি স্টিফেন হকিং । মাত্র ২১ বছর বয়সে মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত হন । ডাক্তার বলেছিলেন বড়জোড় আর ২ বছর বাঁচবেন । কিন্তু না এ অদম্য ব্যাক্তিটি সবাই কে অবাক করে দিয়ে আরো ৫৫ বছর বেঁচেছিলেন ।

মোটর নিউরন কি ?

প্রাণি দেহের স্নায়ুতন্ত্র অনুভুতি গ্রহণ করে । স্নায়ুতন্ত্রের একক নিউরন । নিউরন গৃহিত অনুভুতি মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয়। মস্তিষ্ক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যা মোটর নিউরনের মাধ্যমে ত্রিয়াস্থলে আসে । যার কারণে আমরা আমাদের ঐচ্ছিক পেশি নিজেদের ইচ্ছেমতো চালনা করতে পারি । ঐচ্ছিক পেশির কারণেই আমার হাঁটা - চলা, কথা বলা ইত্যাদি কাজগুলো করতে পারি । দুরারোগ্য স্নায়বিক রোগ এ্যামায়াট্রেফিক ল্যাটারাল স্লেরোসিস হলে মোটর নিউরোন নষ্ট হয়ে যায় বা মারা যায় । এর কারণে মস্তিষ্কের সংকেত পেশীতে আসতে পারে না । ফলে সকল পেশী অবশ হয়ে যায় । বিজ্ঞানী স্টিফেন এই রোগেই আক্রান্ত ছিলেন । এ রোগটি যে কোনো বয়সেই হঠাৎ করে হতে পারে ।

একটি হুইলচেয়ারের গল্প

২১ বছর বয়স থেকেই কথা অস্পষ্ট হয়ে যায় হকিংয়ের। আর একেবারে কথা বন্ধ হয়ে যায় ১৯৮৫ সাল থেকে। সে বছর সার্নের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে জেনেভায় গিয়েছিলেন হকিং। হঠাৎই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক করতে তার ট্রাকিওকটমি (গলায় গর্ত করে তার ভেতর দিয়ে উইন্ডপাইপ ঢুকিয়ে দেওয়া) করতে হয়। এরপরই বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন তিনি। বাকশক্তি হারানোর পর বানান লেখা কার্ড ব্যবহার করে কথা বলা শুরু করেন খ্যাতিমান এই পদার্থবিজ্ঞানী। 

এক-এক করে বর্ণ লিখে নিজের কথাগুলো বলতেন। এটা ছিল অনেক ধৈর্যের কাজ। এছাড়া চোখের চাহনিতে বোঝানোর চেষ্টা করতেন, কী বলতে চান। হকিংয়ের এমন কষ্ট দেখে তার পদার্থবিদ বন্ধু মার্টিন কিং গোপন যোগাযোগ করেন ক্যালিফোর্নিয়ার সংস্থা ‘ওয়ার্ডপ্লাস’ এর সঙ্গে। তারা ‘ইকুয়ালাইজার’ নামে একটি প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ করছিল, সেখানে হাতে রাখা যন্ত্রে ক্লিক করে কম্পিউটারের মাধ্যমে শব্দ বা কথা বোঝানো যায়। হকিংয়ের জন্য ‘ইকুয়ালাইজার’ এর সঙ্গে যুক্ত করা হল ‘স্পিচপ্লাস’ নামে একটি সংস্থার তৈরি যন্ত্র ‘স্পিচ সিন্থেসাইজার’। 

আরো পড়তে পারেন

হুইলচেয়ারের একটি হাতলে লাগিয়ে দেওয়া হল সেটি। হাতের ইশারায় যন্ত্রের মাধ্যমে কম্পিউটারে লেখা হতো। আর সিন্থেসাইজার মারফত ভেসে উঠল সেই কথা। এক মিনিটে ১৫টি পর্যন্ত যান্ত্রিক শব্দ প্রকাশ করতে পারতেন হকিং। এতে তার প্রথম বলা কথাই ছিল “এক জন সহকারী দরকার, ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ শেষ করতে হবে’।” এভাবেই এক দশকেরও বেশি সময় কাটানোর পর ১৯৯৭ সালে হকিংয়ের সঙ্গে দেখা হয় ‘ইনটেল’ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা গর্ডন মুরের। 

তিনি হকিংকে মাইক্রোপ্রসেসর যুক্ত ইনটেলের আসল কম্পিউটার ব্যবহারের আহ্বান জানান। তিনি সে আহ্বানে সাড়া দিলে তারপর থেকে হকিংকে যাবতীয় প্রযুক্তিগত সাহায্য দিত ইনটেল। প্রতি দু'বছর অন্তর তার কম্পিউটার বদলে দিত তারা। এভাবে বেশ কিছু বছর চলার পর ২০০৮ সালে হাতে যে সামানো সাড়া দেয়ার শক্তি ছিলো সেটাও চলে গেলো।সম্পূর্ণ প্যারালাইজড হয়ে গেল তার শরীর।

তখন তার সহকারী নতুন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করলেন। ইনফ্রারেড রশ্মির সাহায্যে কাজ করা ‘চিক স্পিচ’ নামের এ যন্ত্রটি হকিংয়ের চশমার সঙ্গে লাগানো হয়। আর এ যন্ত্রের অপর অংশ সফটওয়্যারসহ লাগানো হয় তার গালে। এতদিনে তার মাথাও একদিকে বেঁকে গিয়েছে। আর গালের একপাশ সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়ে। তখন শুধু গালের একটিমাত্র পেশি কাজ করে। ওই গালের একপাশের পেশির কম্পনই পড়ে ফেলতে পারতো ‘চিক স্পিচ’ নামের সফটওয়্যারটি। 

তবে ২০১১ সালে এসে গালের একপাশের পেশিও নাড়াচাড়া বন্ধ করে দেয়। সর্বশেষ মিনিটে মাত্র দুটি শব্দ বলতে পারতেন হকিং। তখন তিনি ইনটেলের  এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা গর্ডন মুরকে লেখেন, ‘কথা বলার গতি কমে গিয়েছে। আপনার সংস্থা কি সাহায্য করতে পারে?’ এরপর হকিং এর ৭০তম জন্মদিনে ইনটেলের গোটা ল্যাবই নিয়ে আসা হয় ক্যামব্রিজে। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরও হকিং এর কথা বলার শক্তি বৃদ্ধি করতে পারেনি ।

১৪ই মার্চ ২০১৮ সালে মৃত্যু বরণ করেন এ মহান বিজ্ঞানী। নিজের সকল প্রতিবন্ধতকাকে জয় করে আমাদের জন্য রেখে যান বিশ্ব জয়ের অনুপ্রেরণা ।

জগদ্বিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের ব্যবহৃত হুইল চেয়ারটি প্রায় তিন কোটি ৩০ লাখ টাকায় বিক্রি হয় । চেয়ার বিক্রিত এই অর্থ দুটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয় যার একটি স্টিফেন হকিং ফাউন্ডেশন এবং অন্যটি মোটর নিউরন ডিজিসেস অ্যাসোসিয়েশন।

এক একটি জীবন সংগ্রামের মাধ্যমেই জন্ম নেয় এক একটি কিংবদন্তি । যারা হয় অনুপ্রেরণা।আশা করি সকল বাধাকে জয় করে তোমরাও হয়ে উঠবে এক একটি গল্প । ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে তাদেরকেও জানার সুযোগ করে দেওয়ার অনুরোধ রইল ।

আরো পড়তে পারো

জুয়েল

আমি বিশ্বাস করি শিক্ষা কোনো বাণিজ্যিক পণ্য নয়। শিক্ষা সকলের অধিকার। আসুন আমরা প্রত্যেক শিশুর স্বপ্ন জয়ের সারথি হই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন